ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে ফিরছেন কিন্তু যুদ্ধবিরতির আনন্দ ম্লান হয়ে যাচ্ছে গাজাবাসীর কাছে। কারণ নিখোঁজ মৃত স্বজনদের সন্ধান পাচ্ছেন না তারা। গাজায় নিহতদের জন্য ব্যবহৃত অস্থায়ী কাফনের মোটা নাইলনের ব্যাগগুলো খুব সাবধানতার সঙ্গে ধরে রেখে ছেলের অনুসন্ধান করেছিলেন আবু মুহাম্মদ গাইথ। তিনি দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস শহরের নাসের হাসপাতালের মর্গের ভিতরে ছেলের সন্ধানে এসেছেন। কিন্তু মৃত ছেলের বদলে কেবল অজ্ঞাত মৃতদেহের অংশ এবং খণ্ডিত দেহাবশেষ দেখতে পান। এই দৃশ্য দেখে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, শোক এবং ক্লান্তি তাকে আকড়ে ধরে।তবুও, তিনি শক্তি সঞ্চয় করে তার ১৭ বছর বয়সী মুহাম্মদের সন্ধান করতে থাকেন।
হঠাৎ মৃতদেহ থেকে ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের দিকে মনোযোগ সরিয়ে নেন তিনি। একটি হলুদ প্লাস্টিকের ব্যাগে এক জোড়া স্যান্ডেল, কমলা রঙের সোয়েটার, একটি কালো জ্যাকেট, ট্র্যাকস্যুট প্যান্টের দিকে তাকিয়ে কিছু খুঁজতে থাকেন।
‘কেউ কী হলুদ সোলের স্যান্ডেল দেখেছেন? দয়া করে যদি খুঁজে পান তাহলে আমাকে জানান’, আবু মুহাম্মদ অন্যদের কাছে অনুরোধ করতে থাকেন এক সময়।
শুধু আবু মুহাম্মদ নয় গতকাল মঙ্গলবার ভোরে তার মতোই মর্গে এসেছিলেন আরো অনেকে। রাফাহতে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্সের উদ্ধার করা বেশ কয়েকটি লাশের মধ্যে তাদের প্রিয়জনদের খুঁজতে এসেছিলেন তারা।
আবু মুহাম্মদ গাইথ হাঁটু গেড়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন, তার মুখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কণ্ঠে দুঃখ এবং অসহায়ত্ব নিয়ে বললেন, ‘আমি আর তার মৃতদেহ খুঁজব না, শুধু তার স্যান্ডেলটা খুঁজে দেখব।’ এরপর তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘তুমি দেখতে পাচ্ছ আমরা কী অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি।
গত রবিবার ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি রাফাহ এবং অন্যান্য স্থানে তাদের বেশিরভাগ ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছে। ১৫ মাস ধরে অবিরাম গোলাবর্ষণের ফলে গাজার প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, অনেকেই বোমা হামলা ও ধ্বংসস্তূপের নিচে নিহত প্রিয়জনদের মৃতদেহ সঠিকভাবে উদ্ধার করার সুযোগ পাননি।
ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো, অ্যাম্বুলেন্স এবং বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর ইসরায়েলের হামলা তারা প্রিয়জনদের মৃতদেহ খুঁজে পাননি। আবু মুহাম্মদ গাইথ মুহাম্মদের ছেলে গত নভেম্বর থেকে নিখোঁজ। যুদ্ধবিরতির পর তিনি দ্রুত রাফাহতে তার বাড়িতে ফিরে আসেন।
আবু মুহাম্মদ নিশ্চিত, তার ছেলে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করার সময় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলি বা গোলাগুলিতে নিহত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ও আমাদের কিছু জিনিসপত্র নিতে ক্যাম্প থেকে নিজের বাড়িতে রওনা হয়েছিল। কিন্তু কিছুই ফিরে আসেনি এবং সেও না।’
নিখোঁজ হওয়ার দিন থেকে আবু মুহাম্মদ সন্তানকে খুঁজে বের করার জন্য রেড ক্রস, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং যারা সাহায্য করতে পারেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। এমনকি তিনি রাফায় তার ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতেও ফিরে আসেন। তিনি বলেন, ‘আমি সর্বত্র খোঁজ করেছি। তার মা এবং তার বোনেরা আমাকে প্রশ্ন করে, কিন্তু তাদের আমি উত্তর দিতে পারি না।’
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, যুদ্ধে প্রায় ৪৭ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। তবে, বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত ল্যানসেট মেডিকেল জার্নাল ধারণা করছে, মৃতের প্রকৃত সংখ্যা ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে ৪১ শতাংশ বেশি হবে।
গত মে মাসে জাতিসংঘের মানবিক বাহিনী ওসিএইচএ বলেছিল, গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে ১০ হাজারের বেশি লোক চাপা পড়ে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই সময়ে অঞ্চলে আধুনিক সরঞ্জাম না থাকায় মৃতদেহগুলো উদ্ধার করতে তিন বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে বলা হয়েছিল।
রাফায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুসন্ধান চালিয়েও ফারাজ আবু মোহসেন তার ছেলের কোনো সন্ধান পাননি। খান ইউনিসে ফিরে আসার পথে দূরে শরীরের বিভিন্ন অংশ এবং ছেঁড়া পোশাক দেখতে পান। জিনিসপত্রগুলো তার ছেলের বলে চিনতে পেরেছিলেন।
এই বাবা বলেন, ‘আমি তাকে জীবিত খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। সারাদিন খোঁজাখুঁজির পর খান ইউনিসের কাছে ফিরে যাওয়ার সময় আমার পা কিছু হাড়ের সঙ্গে ধাক্কা খায়। আমি সেগুলো সরিয়ে ফেলি। আমার ছেলের পোশাক, তার কালো শার্ট, নীল প্যান্ট এবং স্নিকার্স খুঁজে পাই। আমি জানতাম এটা সে-ই।’ তিনি একটি ব্যাগে মৃতদেহটির দেহাবশেষ সংগ্রহ করেন এবং মাটির নিচে চাপা দেন। তিনি আবারও ফিরে আসবেন সেখানে, সেই প্রতিশ্রুতিও করেন।
কষ্টে তার কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, ‘আমরা কেউই কল্পনা করিনি যে, তার দেহের কেবল কয়েকটি হাড়ই অবশিষ্ট থাকবে।’
অনিশ্চয়তার মধ্যে পরিবারগুলো
গাজায় বর্তমান ফরেনসিক সম্পদ সীমিত। দক্ষিণ অঞ্চলে মাত্র তিনজন বিশেষজ্ঞ এবং উত্তরে কোনো বিশেষজ্ঞই নেই। এই ঘাটতি ইতিমধ্যেই চাপের মুখে থাকা ব্যবস্থাকে আরো চাপের মুখে ফেলেছে। বিশেষ করে ইসরায়েলি হামলার পর প্রচুর পরিমাণে দেহাবশেষ উদ্ধারের পর।
তিনি বলেন, ‘আমি যখনই কাফন খুলেছি তখনই একটি সংখ্যা হারিয়ে ফেলেছি। আমি জানি না আমি তাকে কখনও খুঁজে পাব কিনা, তবে আমি অনুসন্ধান চালিয়ে যাব।’